চোখের আলো হারিয়ে গেছে দেড় দশকের অধিক সময় আগে, তবুও দিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের আলো। করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর। বলছিলাম গণিতের শিক্ষক মো. শওকত আলীর কথা। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর সদরে। এলাকায় তিনি প্রাইভেট শওকত মাস্টার নামে পরিচিত। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি বেশি দূর। কিন্তু এ পর্যন্ত ২ থেকে আড়াই হাজার শিক্ষার্থীকে দিয়েছেন পথের দিশা।
২০০৫ সালে হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। চোখের রেটিনা নার্ভ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়ায় অন্ধত্ব বরণ করেন এ মেধাবী শিক্ষক। বাংলাদেশ ও ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকবার, নিজের যা সঞ্চয় তার সবটা ঢেলে দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি দৃষ্টিশক্তি। অবশেষে অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। আত্মমর্যাদাহানির অভাবে কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি। তাই ভালো চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন। কিন্তু থেমে নেই তার জ্ঞান ছড়ানোর ব্রত।
এখনো পড়ান তিনি। দিব্যি ব্লাকবোর্ডে লিখে যান গণিতের জটিল জটিল সমাধান। শিক্ষার্থীর দুর্বল দিককে চিহ্নিত করে মেধা অনুযায়ী পাঠদান করে যাচ্ছেন। এ জন্য অনেক অভিভাবক এখনো তাদের ছেলেমেয়ের পথের দিশারী হিসেবে তাকেই বেছে নেন। গত আশির দশকে মাগুরা থেকে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বোয়ালমারীতে আসেন তিনি। আত্মীয়তার সূত্রে উপজেলার এক মরহুম রাজনীতিবিদের পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর দায়িত্ব নেন সেসময়। তার তত্ত্বাবধানে এ পরিবারের সবাই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৮৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ১০ জন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিয়ে কোচিং করান।
পরবর্তী বছর প্রত্যেকে ভালো ফলাফল করলে নাম ছড়িয়ে পড়ে তার। এরপর থেকে পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। থেকে যান বোয়ালমারীতেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রাইভেট শিক্ষকতা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিকটও ভরসারস্থল হয়ে দাঁড়ান শওকত আলী। আবাসিক-অনাবাসিক মিলে কোনো কোনো বছর ১০০ থেকে ১৩০ জন শিক্ষার্থীকে ব্যাচ করে পাঠদান দিতে হতো। শিক্ষার্থীদের ভিড়ে একসময় গোসল, খাওয়া-দাওয়ার সময় না পেলেও অন্ধ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে কমে আসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। বর্তমানে ১০/১২জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি।
তার কাছ থেকে শিক্ষার আলো নেওয়া অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার, এমবিবিএস ডাক্তার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ অফিসার, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। করোনার প্রাদুর্ভাবে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসে। শওকত আলী প্রাইভেট পড়িয়ে যে অর্থ পান, তা দিয়ে বাসাভাড়া দিয়ে অনেক কষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।
এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে এ শিক্ষকের। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক বছর। ছেলেও বিয়ে করে ঢাকায় থাকেন, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে অল্প টাকার চাকরি করেন। শিক্ষকের ইচ্ছা ছিল এক টুকরো জমি কিনে নিজের একটা বাড়ি করার। কিন্তু চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চিত টাকার সবটাই শেষ করে ফেলেন। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো আবার চোখের আলো ফিরে আসতো। এখন ছাত্র-ছাত্রী কমে যাওয়ায় বাসা ভাড়ার টাকাও পরিশোধ করতে কষ্ট হয় বলে জানান এই শিক্ষক। তিনি বলেন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজের বা সংসারের কথা চিন্তা করিনি। কয়েকশ গরিব ছেলে-মেয়েকে বিনা বেতনে পড়িয়েছি।
এসএসসিতে ফরম ফিলাপে অপারগ ছাত্রছাত্রীদের নিজের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এখন নিজেই চলতে পারি না। সত্যি বলতে কি, আমি ভীষণ কষ্টে আছি। আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, পথে পথে যে আলো জ্বালিয়ে ফেরেন, অথচ নিজের ঘরেই নেই যার আলো জ্বালাবার সামর্থ্য।